প্রতীক প্রাণী : Hydra
Hydra নিডেরিয়া (Cnidaria) পর্বের সরল ধরনের জলজ প্রাণী। এরা প্রথম দ্বিভ্রূণস্তরী প্রাণী (diploblastic লিনিয়াস (Carolus Linnacus, 1707-1778) এর নাম দেন Hydra । গ্রিক রূপকথার নয় মাথাওয়ালা ড্রাগনের নামানুসারে Hydra-র নামকরণ করা হয়। ঐ ড্রাগনটির একটি মাথা কাটলে তার বদলে দুই বা তার বেশি মাথা গজাতো। Hydra ঐ ড্রাগনের মতো হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে, তাই অনেক সময় বহু মাথাওয়ালা সদস্য আবির্ভুত হয়। মহাবীর হারকিউলিস অবশেষে এ দানবকে বধ করেন ।
বাংলাদেশে Hydra-র বিভিন্ন প্রজাতিঃ
বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন প্রজাতির Hydra পাওয়া যায়। তবে Hydra vulgaris নামক হালকা হলুদ-বাদামী বর্ণের, Pelmatohydra oligactis নামক বাদামী বর্ণের, Chlorohydra viridissima নামক সবুজ বর্ণের এবং Hydra gangetica নামক সাদা বা হালকা গোলাপি বর্ণের Hydra এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার স্বাদ পানির জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রজাতির Hydra-র মধ্যে বাংলাদেশে Hydra vulgaris সুলভ বলে এখানে এ প্রজাতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। Hydra একটি একক মুক্তজীবী প্রাণী। মিঠাপানিতে (খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ,ঝর্ণা) নিমজ্জিত কঠিন বস্তু এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচের তলে সংলগ্ন থেকে নিম্নমুখী। হয়ে ঝুলে থাকে। স্থির, শীতল ও পরিষ্কার পানিতে এদের অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। ঘোলা, উষ্ণ ও চলমান পানিতে এদের খুব কম পাওয়া যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় এরা দেহ ও কর্ষিকাকে সর্বোচ্চ প্রসারিত করে পানিতে দুলতে থাকে। কোন কিছুর সংস্পর্শে এরা দেহকে সঙ্কুচিত করে ফেলে। এরা মাংসাশী অর্থাৎ অন্য কোনো প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে। কর্ষিকার সাহায্যে খাদ্য গ্রহণ করে। চলাফেরা করে দেহের সংকোচন-প্রসারণ ও কর্ষিকার সাহায্যে দেহপ্রাচীরের মাধ্যমে ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ায় শ্বসন ও রেচন সম্পন্ন করে। মুকুলোদগম ও দ্বিবিভাজনের মাধ্যমে অযৌন জনন এবং জননকোষ সৃষ্টি করে যৌন জনন সম্পন্ন হয়। Hydra-র গায়ে সংলগ্ন দুটি কোষ থাকে। এদের পুনরুৎপত্তি (regeneration) ক্ষমতা প্রচন্ড। হাইড্রার পুনৎপত্তি সম্পর্কে ব্যাখা দেন ট্রেম্বলে।
হাইড্রার শ্রেণিতাত্ত্বিক অবস্থান (Systematic Position):
Kingdom: Animalia
Phylum: Cnidaria
Class: Hydrozoa
Order: Hydroida
Family: Hydridae
Genus: Hydra
Species: Hydra vulgaris
Hydra-র বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যঃ
আকার-আকৃতি : Hydra-র দেহ নরম ও অনেকটা নলাকার। দেহের একপ্রান্ত খোলা (ওরাল বা মৌখিক প্রান্ত) এবং অপরপ্রান্ত বন্ধ (অ্যাবওরাল বা বিমৌখিক প্রান্ত)। খোলা প্রান্তে মুখছিদ্র অবস্থিত, আর বন্ধ প্রান্তটি কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত থাকে। দেহ Me অরীয় প্রতিসম (radial symmetry) এবং ১০ থেকে ৩০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা ও প্রায় ১ মিলিমিটার চওড়া।
বর্ণ : প্রজাতিভেদে Hydra-র বর্ণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। Hydra vulgaris প্রায় বর্ণহীন (হালকা হলুদ – বাদামী), তবে গৃহীত খাদ্যের প্রকৃতি অনুযায়ী বর্ণ বৈষম্য দেখা যায় ।
বহির্গঠন : একটি পরিণত Hydra-র দেহকে প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা যায় : ১. হাইপোস্টোম, ২. দেহকান্ড ও ৩. পদতল বা পাদ-চাকতি । নিচে এসব অংশের বর্ণনা দেয়া হলো।
ক. হাইপোস্টোম (Hypostome) : এটি দেহের মুক্ত প্রান্তে অবস্থিত, মোচাকৃতি, ছোট ও সংকোচন-প্রসারণশীল অংশ। এর চূড়ায় বৃত্তাকার মুখছিদ্র অবস্থিত। মুখছিদ্রপথে খাদ্য গৃহীত ও অপাচ্য অংশ বহিষ্কৃত হয় ।
খ.দেহকান্ড (Trunk): হাইপোস্টোমের নিচ থেকে পদ চাকতির উপর পর্যন্ত সংকোচন প্রসারণশীল অংশটি দেহকান্ড। এতে নিচে বর্নিত অংশ গুলো পাওয়া যায়।
• কর্ষিকা (Tentacle) : হাইপোস্টোমের গোড়ার চতুর্দিক ঘিরে ৬-১০টি সরু, দেহ অপেক্ষা লম্বা ও ফাঁপা সুতার মতো কর্ষিকা অবস্থিত। কর্ষিকার বহিঃপ্রাচীরে অসংখ্য ছোট টিউমারের মতো নিনমাটোসিস্ট ব্যাটারী (nematocyst battery) থাকে। প্রত্যেক ব্যাটারীতে থাকে কয়েকটি করে বিভিন্ন ধরনের নেমাটোসিস্ট। কর্ষিকা ও নেমাটোসিস্ট পারস্পরিক সহযোগিতায় আহার সংগ্রহ চলন এবং আত্মরক্ষায় অংশ নেয়।
• মুকুল (Bud) : গ্রীষ্মকালে যখন পর্যাপ্ত আহার পাওয়া যায় তখন মুকুল সৃষ্টিরও অনুকূল সময়। এমন পরিবেশে দেহের প্রায় মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে এক বা একাধিক মুকুল সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক মুকুল একেকটি নতুন সদস্যের জন্ম দেয় । মুকুলোদগম Hydra-র অন্যতম অযৌন জনন প্রক্রিয়া।
• জননাঙ্গ (Gonad) : হেমন্ত ও শীতকালে দেহকাণ্ডের উপরের অর্ধাংশে এক বা একাধিক কোণাকার শুক্রাশয় (testes) এবং নিচের অর্ধাংশে এক বা একাধিক গোলাকার ডিম্বাশয় (ovaries) নামক অস্থায়ী জননাঙ্গ দেখা যায়। জননাঙ্গ যৌন জননে অংশ গ্রহণ করে।
গ. পাদ-চাকতি (Pedal disc) : দেহকাণ্ডের নিম্নপ্রান্তে অবস্থিত গোল ও চাপা অংশে পাদ-চাকতি রসের সাহায্যে প্রাণী কোনো তলের সাথে লেগে থাকে।পাদ-চাকতি থেকে নিঃসৃত রস বুদবুদ (bubble) সৃষ্টি করে প্রাণীকে ভাসিয়ে রাখতেও সাহায্য করে। এদের ক্ষণপদ গঠনকারী কোষের সাহায্যে গ্লাইডিং চলন সম্পূর্ণ হয়।
হাইড্রার দেহপ্রাচীরের কোষসমূহঃ
ক. এপিডার্মিসঃ
১. পেশি-আবরণী কোষ
২. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ
৩. সংবেদী কোষ
8. স্নায়ু কোষ
৫. গ্রন্থি কোষ
৬. জনন কোষ এবং
৭. নিডোসাইট
খ. মেসোগ্লিয়াঃ কোন কোষস্তর নয়, একে সংযোগকারী স্তর বলা হয় ।
গ. গ্যাস্ট্রোডার্মিসঃ
১. পুষ্টি কোষ
২. গ্রন্থি কোষ
৩. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ,
৪. সংবেদী কোষ এবং
৫. স্নায়ু কোষ ।
আদর্শ নিডোসাইটের গঠন (Structure of a typical Cnidocyte):
Hydra-র একটি আদর্শ নিডোসাইট দেখতে গোল, ডিম্বাকার, নাশপাতি আকার, পেয়ালাকার বা লাটিম আকৃতির এবং নিচে বর্ণিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত।
১. আবরণ (Membrane) : প্রতিটি কোষ দ্বিস্তরী আবরণে আবৃত। স্তরদুটির মাঝখানে দানাদার সাইটোপ্লাজম এবং কোষের গোড়ার দিকে একটি নিউক্লিয়াস থাকে।
২. নেমাটোসিস্ট (Nematocyst) : নিডোসাইটের অভ্যন্তরে অবস্থিত, কাইটিনের মতো পদার্থে নির্মিত আবরণে আবৃত ও সুত্রকযুক্ত একটি ক্যাপসুলের নাম নেমাটোসিস্ট। আদর্শ নিডোসাইটে ক্যাপসুলটি প্রোটিন ও ফেনল-এর সমন্বয়ে গঠিত বিষাক্ত তরল হিপনোটক্সিন (Hypnotoxin) এ পূর্ণ থাকে। লম্বা, সরু, ফাঁপা সূত্রকটি যা প্রকৃতপক্ষে ক্যাপসুলেরই অগ্রপ্রান্তের অভিন্ন প্রসারিত অংশ সেটি অবস্থান করে। সূত্রকের চওড়া গোড়াটিকে বাট (butt) বা শ্যাফট (shaft) বলে। এতে তিনটি বড় তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বার্ব (barb) এবং সর্পিল সারিতে বিন্যস্ত ক্ষুদ্রতর কাঁটার মতো অসংখ্য বার্বিওল (barbules) দেখা যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় সূত্রকটি বাট ও কাঁটাসহ থলির ভিতর ঢুকানো থাকে।
৩. অপারকুলাম (Operculum) : স্বাভাবিক অবস্থায় নেমাটোসিস্টের সূত্রক ও ক্যাপসুল যে ঢাকনা দিয়ে আবৃত থাকে তার নাম অপারকুলাম। উন্মুক্ত অবস্থায় এটি পাশে সরে যায়।
৪. নিডোসিল (Cnidocil) : নিডোসাইট কোষের মুক্ত প্রান্তের শক্ত, দৃঢ়, সংবেদনশীল কাঁটাটি নিডোসিল। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি রূপান্তরিত সিলিয়াম (cilium)। নিডোসিল ট্রিগারের মতো কাজ করে ফলে অপারকুলাম সরে যায় এবং প্যাঁচানো সূত্রকটি বাইরে বেরিয়ে আসে।
৫. পেশিতন্তু ও ল্যাসো (Muscle fibre & Lasso) : কোষের সাইটোপ্লাজম ও নেমাটোসিস্টের প্রাচীরে সংকোচনশীল কিছু পেশিতন্তু থাকে। এছাড়াও কোষের নিচের প্রান্তে ল্যাসো নামের একটি প্যাঁচানো সূত্রক দেখা যায়।
নেমাটোসিস্টের প্রকারভেদ (Types of nematocysts):
নিক্ষিপ্ত সূত্রকের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানী ভার্ণার (Werner) ১৯৬৫ সালে নিডারিয়া জাতীয় প্রাণীদের দেহ থেকে ২৩ ধরনের নেমাটোসিস্ট শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে চার ধরনের নেমাটোসিস্ট Hydra-তে পাওয়া যায়। যথাঃ
১. স্টিনোটিল বা পেনিট্র্যান্ট (Stenotile or Penetrant) : Hydra-র চার ধরণের নেমাটোসিস্টের মধ্যে এগুলোই বৃহত্তম। এদের সূত্রক লম্বা, ফাঁপা, শীর্ষ উন্মুক্ত, বাট প্রশস্ত এবং তিনটি বড় তীক্ষ্ণ বার্ব ও তিন সারি সর্পিলাকারে সজ্জিত অতি ক্ষুদ্র বার্বিউলযুক্ত। এর ভিতরে হিপনোটক্সিন (hypnotoxin) নামক বিষাক্ত তরল থাকে। শিকারের দেহে সূত্রক বিদ্ধ করে বিষাক্ত হিপনোটক্সিন প্রবেশ করিয়ে তাকে অজ্ঞান ও অবশ করে ফেলে।
২. ভলভেন্ট (Valvent) : এগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। সূত্রকটি খাটো, মোটা, স্থিতিস্থাপক, কাঁটাবিহীন এবং বদ্ধ শীর্ষযুক্ত নেমাটোসিস্ট। ক্যাপসুলের ভিতর সূত্রকের একটি মাত্র প্যাঁচ থাকে, কিন্তু নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে কর্ক-স্ক্রুর মতো অনেকগুলো প্যাঁচের সৃষ্টি করে। এটি শিকার কিংবা কোন বস্তুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
৩. স্ট্রেপটোলিন গ্লুটিন্যান্ট (Streptoline glutinant) : এর সূত্রক লম্বা, সর্পিলাকারে সজ্জিত কাঁটাযুক্ত, বাট সুগঠিত নয় এবং শীর্ষদেশ উন্মুক্ত। এগুলো আঠালো রস ক্ষরণ করে চলনে এবং শিকার আটকাতে সাহায্য করে।
৪. স্টেরিওলিন গুটিন্যান্ট (Stereoline glutinant) : এগুলো ক্ষুদ্রতম নেমাটোসিস্ট; সূত্রক লম্বা, কাঁটাবিহীন, বাট সুগঠিত নয় এবং শীর্ষদেশ উন্মুক্ত। এগুলোও এক ধরনের আঠালো রস ক্ষরণ করে চলন ও শিকার আটকে রাখতে সাহায্য করে।
নেমাটোসিস্টের সুত্রক নিক্ষেপের কৌশল
(Mechanism of discharge of Nematocyst-thread): নেমাটোসিস্টের সুত্রক নিক্ষেপ যুগপৎভাবে একটি রাসায়নিক ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। শিকারের বা শত্রুর সন্ধান অথবা অন্য যেকোনো কারণে নিডোসাইট উদ্দীপ্ত হলে এ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। কোনো শিকার 𝐻𝑦𝑑𝑟𝑎-র কর্ষিকার নিকটবর্তী হলে শিকার-দেহের রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে নেমাটোসিস্ট প্রাচীরের পানিভেদ্য ক্ষমতা বেড়ে যায়। এতে থলির ভিতরে দ্রুত পানি প্রবেশ করায় ভিতরের অভিস্রবণিক চাপও বেড়ে যায়। এসময় শিকার নিডোসাইটের নিডোসিল স্পর্শ করামাত্র এর অপারকুলাম খুলে যখন দ্রুত পানি ভিতরে প্রবেশ করায় হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপ (hydrostatic pressure) বেড়ে গেলে নেমাটোসিস্ট-সূত্রক ক্ষিপ্র গতিতে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
এপিডার্মিস (বা বহিঃত্বক)-এর কোষসমূহঃ
কাজের ভিন্নতা অনুযায়ী Hydra-র এপিডার্মিসের কোষের গঠনে বৈচিত্র্য দেখা যায়। একটি পাতলা ও নমনীয় কিউটিকল (cuticle)-এ আবৃত এপিডার্মিস Hydra-র বহিরাবরণ গঠন করে। Hydra-র এপিডার্মিস ৭ ধরণের কোষ নিয়ে গঠিত। যথাঃ
১. পেশি-আবরণী কোষ (Musculo-Epithelial cell): এপিডার্মিসের সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে এ কোষ অবস্থান করে। বহির্মুখী চওড়া ও অন্তর্মূখী সরু প্রান্তবিশিষ্ট এ কোষগুলো দেখতে কোণাকার। এগুলোর চওড়া প্রান্ত গহ্বরযুক্ত সাইটোপ্লাজোম পূর্ণ, মিউকাস-বস্তুযুক্ত এবং পরস্পর মিলিত হয়ে একটি অভিন্ন আবরণ গঠন করে। ভিতরের সরু প্রান্তের শেষে মায়োনিম (এক ধরনের নমনীয় ও সংকোচন-প্রসারণশীল তন্তু) নির্মিত দুটি পেশি-প্রবর্ধন দেহ অক্ষের সমান্তরালে অবস্থান করে। কর্ষিকায় কোষগুলো বেশ বড় ও চাপা এবং কয়েকটি করে নিডোব্লাস্ট (পরিস্ফুটনরত নিডোসাইট) ধারণ করে।
কাজ : আবরণী কোষের মতো দেহাবরণ সৃষ্টি করে দেহকে রক্ষা করে। প্রবর্ধনগুলো সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে দেহের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে পেশির মতো কাজ করে। মিউকাস দানা কিউটিকল ক্ষরণ করে ও দেহ পিচ্ছিল রাখে। কোষগুলো একাধিক নেমাটোসিস্ট বহন করে। একদিকে দেহাবরণ হিসেবে, অন্যদিকে পেশির মতো কাজ করে বলে এসব কোষকে ‘‘পেশি-আবরণী কোষ” বলা হয়ে থাকে।
২. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ (Interstitial cell): পেশি-আবরণী কোষের অন্তর্মুখী সরু প্রান্তের ফাঁকে ফাঁকে, গুচ্ছাকারে, মেসোগ্লিয়া ঘেঁষে এসব কোষ অবস্থান করে। এগুলো গোল বা তিনকোণা এবং সুস্পষ্ট নিউক্লিয়াস, মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা, রাইবোজোম ও কিছু মাইটোকন্ড্রিয়া যুক্ত।
কাজ: এসব কোষ প্রয়োজনে অন্য যে কোনো ধরনের বহিঃত্বকীয় কোষে পরিণত হয়। পুনরুৎপত্তি ও মুকুল সৃষ্টিতে অংশ নেয় এবং কিছুদিন পরপর অন্যান্য কোষে পরিণত হয়ে দেহের পুরনো কোষের স্থান পূরণ করে।
৩. সংবেদী কোষ (Sensory cell): এগুলো পেশি-আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে, সমকোণে ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো থাকে, তবে কর্ষিকা, হাইপোস্টোম ও পদতলের চারদিকে বেশি দেখা যায়। প্রতিটি কোষ লম্বা ও সরু। এর মুক্ত প্রান্ত থেকে সূক্ষ্ম সংবেদী রোম (sensory hair) বেরোয় এবং অপর প্রান্ত থেকে গুটিকাময় বা নোডিওল যুক্ত (nodulated) সূক্ষ্ন তন্তু নির্গত হয়ে স্নায়ুতন্তুর সাথে যুক্ত হয়।
কাজ: পরিবেশ থেকে বিভিন্ন উদ্দীপনা (যেমন আলো, তাপ প্রভৃতি) গ্রহণ করে স্নায়ুকোষে সরবরাহ করে।
৪. স্নায়ু কোষ (Nerve cell): এসব কোষ মেসোগ্লিয়া ঘেঁষে অবস্থিত, অনিয়ত আকারবিশিষ্ট এবং একটি ক্ষুদ্র কোষদেহ ও দুই বা ততোধিক নোডিওলযুক্ত সূক্ষ্ন শাখান্বিত স্নায়ুরোম নিয়ে গঠিত। তন্তুগুলো পরস্পর মিলে স্নায়ু-জালিকা গঠন করে।
কাজ: সংবেদী কোষে সংগৃহীত উদ্দীপনা দেহের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে।
৫. গ্রন্থি কোষ (Gland cell): এগুলো ক্ষরণকারী দানাবিশিষ্ট এক ধরনের পরিবর্তিত লম্বাকার এপিডার্মাল কোষ। মুখছিদ্রের চারদিকে ও পাদ-চাকতিতে প্রচুর গ্রন্থি কোষ দেখা যায়।
কাজ: মিউকাস ক্ষরণ করে দেহকে কোনো বস্তুর সঙ্গে লেগে থাকতে সাহায্য করে; বুদবুদ সৃষ্ট করে ভাসতে সাহায্য করে। ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে চলনে অংশগ্রহণ করে এবং মুখছিদ্রের গ্রন্থিকোষের ক্ষরণে সাহায্য করে।
৬. জনন কোষ (Germ cell): এসব কোষ জননাঙ্গে অবস্থান করে। জননকোষ দুধরনের: শুক্রাণু ও ডিম্বাণু। পরিণত শুক্রাণু অতি ক্ষুদ্র এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত একটি স্ফীত মস্তক, সেন্ট্রিওলযুক্ত একটি সংকীর্ণ মধ্যখন্ড ও একটি লম্বা বিচলনক্ষম লেজ নিয়ে গঠিত। এর সাথে তিনটি পোলার বডি (polar bodies) যুক্ত থাকে।
কাজ: যৌন জননে অংশগ্রহণ করা।
৭. নিডোসাইট (Cnidocyte): Hydra-র পদতল ছাড়া বহিঃত্বকের সর্বত্র বিশেষ করে কর্ষিকার পেশি-আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে বা ঐসব কোষের ভিতরে নিডোসাইট অনুপ্রবিষ্ট থাকে। কোষগুলো গোল, ডিম্বাকার বা পেয়ালাকার এবং নিচের দিকে নিউক্লিয়াসবাহী ও দ্বৈত আবরণবেষ্টিত বড় কোষ। কোষের মুক্তপ্রান্তে ক্ষুদ্র, দৃঢ়, সংবেদী নিডোসিল (cnidocil) এবং অভ্যন্তরে গহবর ও প্যাঁচানো সুতাযুক্ত নেমাটোসিস্ট বহন করে। গহ্বরটি অপারকুলাম (operculum) দিয়ে ঢাকা। আদর্শ নেমাটোনিস্টের সুতার গোড়ায় ৩টি বড় কাঁটার মতো বার্ব (barb) থাকে এবং গহ্বরটি হিপনোটক্সিন (Hypnotoxin) নামক বিষাক্ত রসে পূর্ণ। পরিস্ফুটনরত নিডোসাইটকে নিডোব্লাস্ট (cnidoblast) বলে।
গ্যাস্ট্রোডার্মিস (বা অন্তঃত্বক)-এর কোষসমূহঃ
এপিডার্মিস অপেক্ষা গ্যাস্ট্রোডার্মিস-এর গঠন অনেকটা সরল এবং নিচের পাঁচধরনের কোষ নিয়ে গঠিত।
১. পুষ্টি কোষ বা পেশি-আবরণী কোষ (Nutritive cell or Musculo -Epithelial Cells) : গ্যাস্ট্রোডার্মিসের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে এসব কোষ অবস্থিত। প্রতিটি কোষ স্তম্ভাকার এবং একটি বড় নিউক্লিয়াস ও গহ্বরযুক্ত। সংযুক্ত প্রান্ত থেকে সূক্ষ্ণ, সংকোচনশীল তন্তুবিশিষ্ট পেশি প্রবর্ধন সৃষ্টি হয়ে মেসোগ্লিয়ার সমকোণে অবস্থান করে । ভেতরের মুক্ত প্রান্তের গঠনের উপর ভিত্তি করে পুষ্টি কোষসমূহকে দুভাগে ভাগ করা যায়, যথা-
• ফ্ল্যাজেলীয় কোষ (Flagellated cell) : এগুলোর মুক্ত প্রান্তে ১-৪টি সুতার মতো ফ্ল্যাজেলা সংযুক্ত থাকে।
• ক্ষণপদীয় কোষ (Pseudopodial cell) : এগুলোর মুক্ত প্রান্ত ক্ষণপদযুক্ত।
কাজ : পেশি প্রবর্ধনগুলো সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে দেহকে সরু ও মোটা করে। মুখ ও কর্ষিকার গোড়ায় অবস্থিত পেশি-প্রবর্ধনগুলো নিজের ছিদ্র বন্ধ করতে স্ফিংক্টার (sphincter)-এর মতো কাজ করে। ফ্ল্যাজেলীয় কোষের ফ্ল্যাজেলা আন্দোলিত হয়ে খাদ্যবস্তু ক্ষুদ্র কণায় পরিণত করে। এ কোষ প্রয়োজনে আন্দোলিত হয়ে মুখছিদ্রপথে পানি প্রবেশ করায় । ক্ষণপদীয় কোষের ক্ষণপদ খাদ্যকণা গলাধঃকরণ করে অন্তঃস্থ খাদ্যগহ্বরে পরিপাক করে।
২. গ্রন্থি কোষ (Gland cell) : বিক্ষিপ্তভাবে পুষ্টিকোষের ফাঁকে ফাঁকে এসব কোষ অবস্থান করে। এগুলোর সংখ্যা মূল দেহ এবং হাইপোস্টোমে সর্বাধিক, পদতলে স্বল্প এবং কর্ষিকায় অনুপস্থিত। গ্রন্থিকোষ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও পেশি-প্রবর্ধনবিহীন। এরা দুরকম হয়ে থাকে-
• মিউকাস ক্ষরণকারী (Mucous secreting) : এগুলো প্রধানত হাইপোস্টোম অঞ্চলে অবস্থিত এবং পিচ্ছিল মিউকাস ক্ষরণ করে।
• এনজাইম ক্ষরণকারী (Enzyme secreting) : অন্যান্য স্থানের কোষগুলো ধরনের যা থেকে পরিপাকের জন্য এনজাইম ক্ষরিত হয়।
কাজ : হাইপোস্টোমের গ্রন্থিকোষ নিঃসৃত মিউকাস খাদ্যদ্রব্য পিচ্ছিল করে গলাধঃকরণে সাহায্য করে। অন্যান্য স্থানে গ্রন্থিকোষ সিলেন্টেরণে এনজাইম-এর ক্ষরণ ঘটিয়ে পরিপাকে সাহায্য করে।
৩. ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ (Interstitial cell) : এগুলো পেশী আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করে। প্রকৃতপক্ষে এসব কোষ এপিডার্মিস থেকে আগত কোষ । এগুলো গোল বা ত্রিকোণাকার এবং সুস্পষ্ট নিউক্লিয়াস, মসৃণ এণ্ডোপ্লাজমিক জালিকায় মুক্ত রাইবোসোম ও কিছু মাইটোকন্ড্রিয়া বহন করে ।
কাজ : এন্ডোডার্মিসের প্রয়োজনীয় যে কোনো কোষ গঠন করাই এর কাজ।
৪. সংবেদী কোষ (Sensory cell) : এগুলো পেশি-আবরণী কোষের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থিত । প্রতিটি কোষ লম্বা শু সরু । কোষের মুক্ত প্রান্ত থেকে নির্গত সূক্ষ্ণ সংবেদী রোম সিলেন্টেরণে উদগত এবং মেসোগ্লিয়া সংলগ্ন প্রান্ত থেকে নির্গত স্নায়ুতন্তুর সাথে যুক্ত থাকে ।
কাজ : সম্ভবতঃ পানির সাথে সিলেন্টেরণে প্রবেশিত খাদ্য ও অন্যান্য পদার্থের গুণাগুণ যাচাই করে স্নায়ুকোষে প্রেরণ করে এবং স্নায়ুকোষ উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
৫. স্নায়ু কোষ (Nerve cell) : এসব কোষ মেসোগ্লিয়া ঘেঁষে অবস্থিত, সংখ্যায় খুব কম। অনিয়ত আকারবিশিষ্ট এবং একটি ক্ষুদ্র কোষদেহ ও দুই বা ততোধিক সূক্ষ্ণ শাখান্বিত তন্তু নিয়ে গঠিত। তন্তুগুলো পরস্পর মিলে স্নায়ু-জালিকা গঠন করে।
কাজ : সংবেদী কোষে সংগৃহীত উদ্দীপনা স্থানান্তর করাই এর কাজ।
মেসোগ্লিয়াঃ
Hydra র এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত জেলির মতো, স্বচ্ছ, স্থিতিস্থাপক তলা এবং মেসোগ্লিয়া বলে। মেসোগ্লিয়া স্তরটি দেহ এবং কর্ষিকা উভয় স্থানে বিকৃত থাকো। তবে কর্ষিকায় সবচেয়ে পাতে সাহায্য পাদ-চাকতিতে সর্বাধিক পুরু । মেসোগ্লিয়ার এ ধরনের বিন্যাস পাদ-চাকতির অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রসারণ প্রতিরোধে উভয় করে এবং কর্ষিকাকে অধিকতর নমনীয়তা প্রদান করে। Hydra-র মেসোগ্লিয়া প্রায় ০১ মাইক্রোমিটার পুরু। উভয় স্তরের কোষ মেসোগ্লিয়া গঠনে অংশ গ্রহণ করে।
কাজ : (i) মেসোগ্লিয়া দেহকে সাপোর্ট করতে সহায়তা করে এবং এক ধরনের ইলাস্টিক কঙ্কাল হিসেবে কাজ করে। (ii) মেসোগ্লিয়া দুটি কোষস্তরের ভিত্তিরূপে কাজ করে। (iii) স্নায়ুকোষ ও সংবেদী কোষতন্তুসমূহ এবং পেশি-আবরণী কোষের সংকোচনশীল মায়োফাইব্রিল ধারণ করে। (iv) মেসোগ্নিয়ায় অবস্থিত পেশি-আবরণী কোষের সংকোচনশীল মায়োফাইব্রিলের সংকোচনে দেহ বা কর্ষিকা খাটো হয়। ফলে দেহ বাঁকানো সম্ভব হয় ।
সিলেন্টেরন (Coelenteron):
Hydra-র দেহের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত ফাঁকা গহ্বরকে সিলেন্টেরন বলে। এটি গ্যাস্ট্রোডার্মিস দ্বারা পরিবৃত্ত থাকে। এতে খাদ্যের বহিঃকোষীয় পরিপাক ঘটে এবং খাদ্যসার, শ্বসন ও রেচন পদার্থ পরিবাহিত হয় বলে একে গ্যাস্ট্রোভাস্কুলার গহ্বর (gastrovascular cavity) বা পরিপাক সংবহন গহ্বর বলা হয়। কর্ষিকাতে সিলেন্টেরন প্রসারিত থাকে বলে এগুলো ফাঁপা হয়। দেহের উপরিভাগে অবস্থিত একটি মাত্র ছিদ্র, মুখছিদ্র দ্বারা সিলেন্টেরন বাইরে উন্মুক্ত হয়।
হাইড্রার খাদ্য গ্রহণ ও পরিপাক প্রক্রিয়া
হাইড্রার খাদ্যঃ
হাইড্রা মাংশাসী প্রাণী। এরা প্রধানতঃ সাইক্লোপস, ড্যাফনিয়া ইত্যাদি ক্রাসটেসিয়া জাতীয় ক্ষুদ্রাকার আর্থোপডা পর্বের প্রাণী ভক্ষণ করে। তাছাড়া হাইড্রা মাছের ডিম, কীট-পতঙ্গের লার্ভা ও অন্যান্য কিছু কিছু আণুবীক্ষণিক প্রাণী খেয়ে থাকে।
হাইড্রার খাদ্য গ্রহণ পদ্ধতিঃ
ক্ষুধার্ত হলে হাইড্রা পাচাকতির সাহায্যে কোন তলের সাথে সংলগ্ন হয়ে কর্ষিকাগুলাে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
এমন অবস্থায় কোন খাদ্য বা প্রাণী বা শিকার কাছে আসলে কর্ষিকার নিডােব্লাস্ট কোষগুলাে থেকে অসংখ্য নিমাটোসিস্ট শিকারের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়।
ভলভ্যান্ট নেমাটোসিস্টগুলাে শিকারের উপাঙ্গাসমূহ পেঁচিয়ে ধরে এবং পেনিট্র্যান্ট নিমাটোসিস্ট শিকারের দেহে হিপ্নোটক্সিন নামক বিষাক্তরস প্রবেশ করিয়ে তাকে অবশ করে ফেলে। এসময় অন্যান্য কর্ষিকাগুলাে শিকার ধরতে সাহায্য করে।
মুখছিদ্রের চারপাশে মিউকাস গ্রন্থি পিচ্ছিল মিউকাস নিঃসৃত করে খাদ্য গলাধঃকরণে সহায়তা করে। হাইপােস্টোম এবং দেহপ্রাচীরের কোষগুলাের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য সিলেন্টেরণে প্রবেশ করে।
পরিপাক (Digestion)
যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অদ্রবণীয়, অশােষণীয়, জটিল খাদ্য নির্দিষ্ট উৎসেচকের প্রভাবে আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে দ্রবণীয়, শোষণীয়, সরল খাদ্যে পরিণত হয়, তাকে পরিপাক বলে।
হাইড্রার খাদ্য পরিপাক পদ্ধতিঃ
হাইড্রার মুখছিদ্রের চারদিকে অবস্থিত পেশী-আবরণী কোষ প্রসারিত হয়েমুখছিদ্র খুলে যায়। এসময় কর্ষিকার সাহায্যে খাদ্য মুখের ভিতর দিয়ে সিলেন্টেরণে প্রবেশ করলে সিলেন্টেরণে খাদ্য পরিপাক হয়। এন্ডােডার্মের গ্রন্থিকোষমূহ থেকে উৎসেচক এবং মিউকাস নিঃসৃত হয়। ফ্লাজেলাযুক্ত পেশী আবরণী কোষ সমূহের ফ্লাজেলা আন্দোলনের দ্বারা সিলেন্টেরণের মধ্যে জীবিত খাদ্য মারা যায় ও কিছুটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয় এবং উৎসেচক ও মিউকাসের সাথে মিশ্রিত হয়। ফলে সিলেন্টেরণের মধ্যে খাদ্য আংশিক পরিপাক হয়।
হাইড্রায় দুই ধরনের পরিপাক সংঘটিত হয়।যথাঃ
(ক) বহিঃকোষীয় পরিপাক ও (খ) অন্তঃকোষীয় পরিপাক।
(ক) বহিঃকোষীয় পরিপাক
কোন নির্দিষ্ট কোষের অভ্যন্তরে পরিপাক না হয়ে কোষের বাইরে কোন নালী বা থলির মধ্যে যে পরিপাক সংঘটিত হয় তাকে আন্তঃকোষীয় বা বহিঃকোষীয় পরিপাক বলে।
হাইড্রার সিলেন্টেরণে আন্তঃকোষীয় বা বহিঃকোষীয় পরিপাক পদ্ধতিতে খাদ্যের কিছুটা পরিপাক ঘটে। সিলেন্টরণে এই আংশিক পরিপাককৃত খাদ্য এরপর ফ্যাগােসাইটোসিস পদ্ধতিতে হাইড্রার এন্ডােডার্মের ক্ষণপদযুক্ত পেশীআবরণী কোষসমূহে প্রবেশ করে।এই কোষের অভ্যন্তরে খাদ্যগহ্বরে খাদ্য জমা হয় ও পরিপাক হয়।
(খ) অন্তঃকোষীয় পরিপাক
কোনও নির্দিষ্ট কোষের অভ্যন্তরে খাদ্য পরিপাক হওয়ার পদ্ধতিকে অন্তঃকোষীয় পরিপাক বলে। হাইড্রার ক্ষণপদযুক্ত পেশী আবরণী কোষের অভ্যন্তরে অন্তঃকোষীয় পরিপাক ঘটে।
পরিশােষণ (Absorption):
পরিপাককৃত সরল খাদ্য অর্থাৎ এ্যামাইনাে এসিড, গ্লুকোজ এবং ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারল ক্ষণপদযুক্ত পেশী আবরণী কোষের সাইট্রোপ্লাজমে শােষিত হয়।
অপর পক্ষে অপাচ্য বর্জ্যপদার্থ পানির সাথে মুখছিদ্রের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। সুতরাং হাইড্রার সিলেন্টেরণে আন্তঃ বা বহিঃকোষীয় এবং ক্ষণপদযুক্ত পেশী আবরণী কোষে অন্তঃকোষীয় পরিপাক সম্পাদিত হয়।
শর্করা
স্নেহ
আমিষ
লাইপোপ্রোটিন
Hydra-র চলনঃ
যে প্রক্রিয়ায় জীবদেহ জৈবিক প্রয়োজনে নিজ চেষ্টায় স্থানান্তরিত হয়, তাকে চলন বলে। সাধারণত এটি প্রাণীর এক স্বতঃস্ফূর্ত সহজাত আচরণ। প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলায়, জনন, খাদ্য সংগ্রহ, আত্মরক্ষা, বিনোদন প্রভৃতি কারণে জীব স্থানান্তরে গমন করে। Hydra সাধারণত নিমজ্জিত বস্তু বা উদ্ভিদের গায়ে সংলগ্ন থাকে, তবে বিভিন্ন উত্তেজকে সাড়া দেয়ার জন্য বা খাদ্য গ্রহণের জন্য স্থান ত্যাগ করতে হয়। চলনের সময় প্রথমে সংবেদী কোষ সাড়া দেয় এবং সে বার্তা বহিঃত্বক ও অন্তঃত্বকের স্নায়ু-জালকের ভিতর সঞ্চালিত হয়। ফলে পেশিতন্তু সঙ্কুচিত হয় এবং চলন প্রক্রিয়া শুরু হয়। Hydra-য় নিচে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের চলন দেখতে পাওয়া যায়।
১. লুপিং (Looping) বা ফাসাচলন : লম্বা দূরত্ব অতিক্রমের জন্য Hydra সাধারণত লুপিং চলনের আশ্রয় নেয়। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে এক পাশের পেশি-আবরণী কোষগুলো সঙ্কুচিত হয় এবং অপর পাশের অনুরূপ কোষগুলো সম্প্রসারিত হয়। ফলে Hydra গতিপথের দিকে দেহকে প্রসারিত করে ও বাঁকিয়ে মৌখিক তলকে ভিত্তির কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং কর্ষিকার গ্লুটিন্যান্ট নেমাটোসিস্টের সাহায্যে ভিত্তিকে আটকে ধরে। এরপর পাদ-চাকতিকে মুক্ত করে মুখের কাছাকাছি এনে স্থাপন করে এবং কর্ষিকা বিযুক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এ পদ্ধতির পুনারাবৃত্তি ঘটিয়ে Hydra স্থান ত্যাগ করে৷ জোঁক বা শুঁয়াপোকা চলার সময় যেভাবে ক্রমান্বয়িক লুপ বা ফাঁসের সৃষ্টি হয় হাইড্রার এ চলনও দেখতে অনেকটা একই রকম হওয়ায় ফাঁসাচলনকে জোঁকা চলন বা শুঁয়াপোকা চলন নামেও অভিহিত করা যায়।
২. সমারসল্টিং (Somersaulting) বা ডিগবাজী : এটি Hydra-র সাধারণ ও দ্রুত চলন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে Hydra দেহকে বাকিয়ে চলনের গতিপথে কর্ষিকায় অবস্থিত গুটিন্যান্ট জাতীয় নেমাটোসিস্টের আঠালো ক্ষরণের সাহায্যে গতিপথকে স্পর্শ করে। এ সময় গন্তব্যস্থলমুখী পেশি-আবরণী কোষের সংকোচন ও অপর পাশের অনুরূপ কোষের সম্প্রসারণ ঘটে। পরে পাদ-চাকতি বিযুক্ত করে কর্ষিকার উপর ভর দিয়ে দেহকে সোজা করে দেয়। পুনরায় দেহকে বাঁকিয়ে পাদ-চাকতির সাহায্যে গতিপথকে স্পর্শ করে। পরে কর্ষিকা মুক্ত করে দেহকে সোজা করে দেয়। এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে Hydra দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
৩. গ্লাইডিং (Gliding) বা অ্যামিবয়েড চলন : এ প্রক্রিয়ায় Hydra পদতলের বহিঃত্বকীয় কোষগুলো থেকে পিচ্ছিল রস ক্ষরণ করে। পরে ঐ স্থান থেকেই প্রক্ষিপ্ত কোষীয় ক্ষণপদের অ্যামিবয়েড চলনের সাহায্যে দেহটি অত্যন্ত ধীরগতিতে মসৃণতলে খুব সামান্য দূরত্বে স্থানান্তরিত হয়।
৪. ভাসা (Floating) : মাঝে মাঝে Hydra পাদ-চাকতির বহিঃত্বকীয় কোষ থেকে গ্যাসীয় বুদবুদ সৃষ্টি করে, ফলে প্রাণী ভিত্তি থেকে বিচ্যুত, হালকা ও উপুর হয়ে পানির পৃষ্ঠতলে ভেসে ওঠে। এখানে বুদবুদ ফেটে মিউকাস ভেলার মতো ছড়িয়ে গেলে Hydra নিম্নমূখী হয়ে ভেসে থাকে। এভাবে প্রাণী ডেউয়ের আঘাতে কিছুদূর ভেসেও যেতে পারে।
৫. সাঁতার (Swimming) : কর্ষিকাগুলোকে ডেউয়ের মতো আন্দোলিত করে এবং দেহকে ভিত্তি থেকে মুক্ত করে Hydra সহজেই দেহকে ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত করে সাঁতার কাটতে পারে।
৬. হামাগুড়ি (Crawling) : এ প্রক্রিয়ায় Hydra কর্ষিকার সাহায্যে কাছাকাছি কোনো বস্তুকে আঁকড়ে ধরে। পরে পাদ-চাকতি মুক্ত ও কর্ষিকা সংকুচিত করে পাদ-চাকতিকে নতুন জায়গায় স্থাপন করে। এ প্রক্রিয়ায় Hydra-র আরোহণ ও অবরোহণ সম্পন্ন হয়।
৭. হাঁটা (Walking) : এ ক্ষেত্রে Hydra তার দেহের ভার পাদ-চাকতির উপর না রেখে কর্ষিকার উপর স্থাপন করে এবং কর্ষিকাকে পায়ের মতো ব্যবহার করে উল্টোভাবে ধীর গতিতে চলতে পারে।
৮. দেহের সংকোচন-প্রসারণ (Body contraction and expansion) : এ প্রক্রিয়ায় Hydra দেহকে মুক্ত করে দেহপ্রাচীরের পেশি-আবরণী কোষের সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে দেহের আকার দ্রুত খাটো ও লম্বা করে, ফলে এক ধরনের চলনের সৃষ্টি হয়।
Hydra–র জননঃ Hydra অযৌন ও যৌন উভয় প্রক্রিয়ায় বংশ বৃদ্ধি করে।
অযৌন জনন (Asexual reproduction):
গ্যামেট উৎপাদন ছাড়াই যে জনন সম্পাদিত হয় তাকে অযৌন জনন বলে। এ ধরনের জনন পদ্ধতিতে একটি মাত্র জনিতা থেকেই নতুন জীবের সৃষ্টি হয়। Hydra দু’ভাবে অযৌন জনন সম্পন্ন করে, যথা— মুকুলোদগম ও বিভাজন।
১. মুকুলোদগম (Budding) : এটি অযৌন জননের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বছরের সব ঋতুতেই বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ থাকায় এটি বেশি ঘটে। নিম্নোক্ত বেশ কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
*প্রক্রিয়ার শুরুতে দেহের মধ্যাংশ বা নিম্নাংশের কোন স্থানের এপিডার্মিসের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ দ্রুত বিভাজিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র স্ফীত অংশের সৃষ্টি করে।
স্ফীত অংশটি ক্রমশ বড় হয়ে ফাঁপা, নলাকার মুকুল (bud)-এ পরিণত হয়। এতে এপিডার্মিস, মেসোগ্লিয়া ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস সৃষ্টি হয়।
*মাতৃহাইড্রার সিলেন্টেরন মুকুলের কেন্দ্রে প্রসারিত হয়।
*মুকুলটি মাতৃহাইড্রা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে বড় হয় এবং শীর্ষপ্রান্তে গঠিত হয় মুখছিদ্র, হাইপোস্টোম ও কর্ষিকা।
*এসময় মাতৃহাইড্রা ও মুকুলের সংযোগস্থলে একটি বৃত্তাকার খাঁজের সৃষ্টি হয়। খাঁজটি ক্রমে গভীর হয়ে মুকুল তথা অপত্য হাইড্রাকে মাতৃহাইড্রা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
*অপত্য হাইড্রার বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রান্তে পাদ-চাকতি গঠিত হয়।
*শিশু হাইড্রা কিছুক্ষণ বিচরণের পর নিমজ্জিত কোনো বস্তুর সংলগ্ন হয়ে স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করে।
ঘটনাক্রমে একটি Hydra-য় বেশ কয়েকটি মুকুলের সৃষ্টি হতে পারে। এসব মুকুল আবার নতুন মুকুল সৃষ্টি করতে পারে। সম্পূর্ণ মাতৃ Hydra-কে তখন একটি দলবদ্ধ প্রাণীর মতো দেখায়। মুকুল সৃষ্টি এবং মাতৃ Hydra থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন জীবন-যাপন করতে প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগে।
২. বিভাজন (Fission) : বিভাজন কোনো স্বাভাবিক জনন প্রক্রিয়া নয় কারণ এটি দৈবাৎ সংঘটিত হয়। কোন বাহ্যিক কারণে হাইড্রার দেহ দুই বা ততোধিক খণ্ডে বিভক্ত হলে প্রত্যেক খণ্ড থেকে নতুন হাইড্রা জন্মায়। একে পুনরুৎপত্তি (regeneration) বলে, কারণ এ প্রক্রিয়ায় দেহের হারানো বা বিনষ্ট অংশ পুনর্গঠিত হয়।
প্রকৃতিবিজ্ঞানী ট্রেম্বলে (Trembley) ১৭৪৪ সালে সর্বপ্রথম Hydra-র পুনরুৎপত্তি ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন অংশের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ অতিদ্রুত বিভক্ত ও রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন কোষ সৃষ্টি করে। এসব কোষ দিয়ে দেহের এ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অংশ গঠনের মাধ্যমে অপত্য হাইড্রার বিকাশ ঘটে। সুতরাং হাইড্রার স্বাভাবিক মৃত্যু নেই। বিভাজন দুভাবে হতে পারে, যথা- অনুদৈর্ঘ্য বিভাজন ও অনুপ্রস্থ বিভাজন।
অনুদৈর্ঘ্য বিভাজন : হাইড্রার দেহ কোনো কারণে লম্বালম্বি দুই বা ততোধিক খন্ডে বিভক্ত হলে প্রত্যেক খণ্ড থেকে পৃথক হাইড্রার উৎপত্তি হয়।
অনুপ্রস্থ বিভাজন : কোনো কারণে হাইড্রার দেহ অনুপ্রস্থভাবে একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হলে প্রত্যেক খণ্ড থেকে পুনরুৎপত্তি প্রক্রিয়ায় নতুন হাইড্রা জন্ম লাভ করে।
যৌন জনন (Sexual reproduction):
নিষেকের মাধ্যমে জাইগোট সৃষ্টির উদ্দেশে দুটি পরিণত জননকোষের (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) নিউক্লিয়াসের একীভবন প্রক্রিয়াকে যৌন জনন বলে। Hydra-র যৌন জননকে আলোচনার সুবিধার জন্য তিনটি শিরোনামভুক্ত করা যায়, যেমন- অস্থায়ী জননাঙ্গ সৃষ্টি, নিষেক ও পরিস্ফুটন।
১. অস্থায়ী জননাঙ্গ সৃষ্টি : অধিকাংশ হাইড্রা একলিঙ্গ (dioecious), তবে কিছু সংখ্যক উভলিঙ্গ (monoecious)–ও আছে। উভলিঙ্গ হলেও এদের স্বনিষেক ঘটে না, কারণ জননাঙ্গগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিপক্কতা লাভ করে। প্রধানত শরৎকালে খাদ্য স্বল্পতার মতো প্রতিকূল পরিবেশে এদের দেহে অস্থায়ী জননাঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং যৌন জনন ঘটে। পুরুষ ও স্ত্রী জননাঙ্গকে যথাক্রমে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় বলে।
ক. শুক্রাশয়ের উৎপত্তি : প্রজনন ঋতুতে সাধারণত দেহের উপরের অর্ধাংশে ও হাইপোস্টোমের কাছাকাছি স্থানের এপিডার্মাল ইন্টারস্টিশিয়াল কোষের দ্রুত বিভাজনের ফলে এক বা একাধিক মোচাকার শুক্রাশয় (testis) সৃষ্টি হয়। এর শীর্ষে একটি বোঁটা বা নিপল (nipple) এবং পরিণত শুক্রাশয়ের অভ্যন্তরে থাকে অসংখ্য শুক্রাণু। শুক্রাশয়ে শুক্রাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে স্পার্মাটোজেনেসিস (spermatogenesis) বা শুক্রাণুজনন বলে। শুক্রাশয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ বারংবার মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে স্পার্মাটোগোনিয়া (spermatogonia) সৃষ্টি করে। পরে এগুলো বৃদ্ধিলাভ করে স্পার্মাটোসাইট (spermatocyte)-এ পরিণত হয়। প্রত্যেক স্পার্মাটোসাইট মিয়োসিস বিভাজনের ফলে ৪টি করে হ্যাপয়েড স্পার্মাটিড (spermatid) উৎপন্ন করে। প্রত্যেক স্পার্মাটিড একেকটি শুক্রাণু sperm-তে পরিণত হয়। প্রত্যেক পরিণত শুক্রাণু নিউক্লিয়াসযুক্ত একটি স্ফীত মস্তক (head), সেন্ট্রিওলযুক্ত একটি সংকীর্ণ মধ্যখন্ড (middle piece) এবং একটি লম্বা, সরু, বিচলনক্ষম লেজ (tail) নিয়ে গঠিত।
খ. ডিম্বাশয়ের উৎপত্তি : প্রজনন ঋতুতে দেহের নিচের অর্ধাংশে, কিন্তু পদতলের সামান্য উপরে এপিডার্মিসের একটি বা দুটি স্থানের কিছু ইন্টারস্টিশিয়াল কোষের বারংবার বিভাজনের ফলে সাধারণত একটি বা দুটি গোলাকার ডিম্বাশয় (ovary) সৃষ্টি করে। প্রত্যেক ডিম্বাশয় থেকে একটি করে ডিম্বাণু (ovam) সৃষ্টি হয়। ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরে ডিম্বাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে উওজেনেসিস (oogenesis) বা ডিম্বাণুজনন বলে।
প্রথমে ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে ওগোনিয়া (oogonia) গঠন করে। এগুলোর মধ্যে কেন্দ্রস্থ একটি কোষ বড় হয়ে উওসাইট (oocyte)-এ পরিণত হয় এবং ছোট কোষগুলোকে গলাধঃকরণ করে। এটি তখন মিয়োসিস বিভাজন ঘটিয়ে ৩টি ক্ষুদ্র পোলার বডি (polar body) ও ১টি বড় সক্রিয় উওটিড (ootid) সৃষ্টি করে। উওটিডটি রূপান্তরিত হয়ে ডিম্বাণুতে পরিণত হয়। পোলার বডিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। ডিম্বাণুর পরিপূর্ণ বৃদ্ধির ফলে ডিম্বাশয়ের বহিরাবরণ ছিঁড়ে যায় এবং ডিম্বাণুকে উন্মুক্ত করে দেয়। এর চারদিকে তখন জিলেটিনের পিচ্ছিল আস্তরণ থাকে।
২. নিষেক (Fertilization) : শুক্রাণু পরিণত হলে শুক্রাশয়ের নিপল বিদীর্ণ করে ডিম্বাণুর সন্ধানে পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরাতে থাকে। ২৪ – ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে না পারলে এগুলো বিনষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে, উন্মুক্ত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যে নিষিক্ত না হলে ডিম্বাণুও নষ্ট হয়ে ক্রমশ ধ্বংস হতে থাকে। শুক্রাণুর ঝাঁক একেকটি ডিম্বাণুর চারদিক ঘিরে ফেলে। একাধিক শুক্রাণু ডিম্বাণুর আবরণ ভেদ করলেও একটি মাত্র শুক্রাণুর নিউক্লিয়াসই ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াসের সাথে একীভূত হয়ে নিষেক সম্পন্ন করে এবং একটি ডিপ্লয়েড (2n) জাইগোট (zygote) গঠন করে।
৩. পরিস্ফুটন (Development) : যেসব ক্রমান্বয়িক পরিবর্তনের মাধ্যমে জাইগোট থেকে শিশু প্রাণীর উৎপত্তি ঘটে তাকে পরিস্ফুটন বলে। জাইগোট নানা ধরনের পরিস্ফুটন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ হাইড্রায় পরিণত হয়।
হাইড্রার পরিস্ফুটনকালে নিম্নোক্ত পর্যায়সমূহ দেখা যায়।
ক. মরুলা (Morula) : জাইগোট মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বারবার বিভক্ত হয়ে বহুকোষী, নিরেট ও গোলাকার কোষপিণ্ডে পরিণত হয়। এর নাম মরুলা।
খ. ব্লাস্টুলা (Blastula) : শীঘ্রই মরুলার কোষগুলো একস্তরে সজ্জিত হয়ে একটি ফাঁপা, গোল ভ্রূণে পরিণত হয়। এর নাম ব্লাস্টুলা। ব্লাস্টুলার কোষগুলোকে ব্লাস্টোমিয়ার (blastomere) এবং কেন্দ্রে ফাঁকা গহ্বরকে ব্লাস্টোসিল (blastocoel) বলে।
গ. গ্যাস্ট্রুলা (Gastrula) : ব্লাস্টুলা গ্যাস্ট্রুলেশন (gastrulation) প্রক্রিয়ায় দ্বিস্তরবিশিষ্ট গ্যাস্ট্রুলায় পরিণত হয়। এটি এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম ও আদি সিলেন্টেরন নিয়ে গঠিত। মাতৃদেহের সাথে সংযুক্ত এ গ্যাস্ট্রুলাকে স্টেরিওগ্যাস্ট্রুলা (stereogastrula) বলে। গ্যাস্ট্রুলার চারদিকে একটি কাইটিন নির্মিত কাঁটাযুক্ত সিস্ট (cyst) আবরণী গঠিত হয়। সিস্টবদ্ধ ভ্রূণটি মাতৃহাইড্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পানির তলদেশে চলে যায়।
ঘ. হাইড্রুলা (Hydrula) : বসন্তের শুরুতে অনুকূল তাপমাত্রায় সিস্টের মধ্যেই ভ্রূণটি ক্রমশ লম্বা হতে থাকে এবং এর অগ্রপ্রান্তে হাইপোস্টোম, মুখছিদ্র ও কর্ষিকা এবং পশ্চাৎপ্রান্তে পাদ-চাকতি গঠিত হয়। ভ্রূণের এ দশাকে হাইড্রুলা বলে। হাইড্রুলা সিস্টের আবরণী বিদীর্ণ করে পানিতে বেরিয়ে আসে এবং স্বাধীন জীবন যাপন শুরু করে।
মিথোজীবীতাঃ যখন দুটি ভিন্ন প্রজাতিভুক্ত জীব ঘনিষ্ঠভাবে সহাবস্থানের ফলে পরস্পরের কাছ থেকে উপকৃত হয়, তখন এ ধরনের সাহচর্যকে মিথোজীবিতা বলে। এ অবস্থায় জীবদুটিকে মিথোজীবী (symbiont) বলা হয়। Chlorohydra viridissima নামক সবুজ হাইড্রা ও Zoochlorella নামক শৈবাল এর মধ্যে এ সম্পর্ক সুস্পষ্ট প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। নিম্নোক্তভাবে এরা পরস্পরের কাছ থেকে উপকৃত হয়।
শৈবালের প্রাপ্ত উপকারঃ
•আশ্রয়ঃ শৈবাল হাইড্রার গ্যাস্ট্রোডার্মাল (অন্তঃকোষীয়) পেশি-আবরণী কোষে আশ্রয় পায় ; •সালোকসংশ্লেষণঃ হাইড্রার শ্বসনে সৃষ্ট CO2-কে সালোকসংশ্লেষণের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে; •খাদ্যোৎপাদন : হাইড্রার বিপাকীয় কাজে উদ্ভূত নাইট্রোজেনজাত বর্জ্য পদার্থকে আমিষ তৈরির বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে।
Hydra-র প্রাপ্ত উপকারঃ
•খাদ্যপ্রাপ্তিঃ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শৈবাল যে খাদ্য প্রস্তুত করে তার উদ্বৃত্ত অংশ গ্রহণ করে হাইড্রা শর্করা জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণ করে;
•শ্বসনঃ সালোকসংশ্লেষণকালে শৈবাল যে O, নির্গত করে হাইড্রা তা শ্বসনে ব্যবহার করে;
•CO, শোষণঃ হাইড্রার শ্বসনে সৃষ্ট CO, শৈবাল গ্রহণ করে প্রাণীকে ঝামেলামুক্ত করে;
•বর্জ্য নিষ্কাশনঃ হাইড্রার বিপাকে সৃষ্ট N♭-ঘটিত বর্জ্য শৈবাল কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় হাইড্রা সহজেই বর্জ্যপদার্থ মুক্ত হয়।
আরও দেখুন...